কোবিড-১৯ এবং ঈদুল ফিতর রায়হান আহমেদ তপাদার

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:০৯:১৩,অপরাহ্ন ২৮ মে ২০২০ | সংবাদটি ৪৫৭ বার পঠিতকোবিড-১৯ এবং ঈদুল ফিতর রায়হান আহমেদ তপাদারএক টুকরো চাঁদ একটি জাতির জীবনে কতখানি আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত শাওয়ালের নতুন এক ফালি চাঁদ। বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো আনন্দ খুশির বড় উপলক্ষ ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণ শুধু ঈদ উদযাপন করছে তা নয় বরং বিশ্ব মুসলমানরাও এই সময়ে ঈদ উদযাপনে শামিল। রোজার শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে ঘিরে মুসলমানদের মাঝে আনন্দ উৎসবের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেণির মানুষ এই ঈদে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বইবে এ দিনে খুশির জোয়ার। বছরের এই দিনটি কাটে খুবই উচ্ছ¡াসমুখরতায় ও জান্নাতি খুশির আমেজে-আবহে অগণিত মুসলিমকে ঘিরে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্য-দূরত্ব ও বিভাজনের যে প্রবণতা-এই দিনে তা থাকবে না। মানুষে মানুষে মিলনের মধ্য দিয়ে দূর হবে অমানবিকতা ও বিদ্বেষ-বিভেদের পাতানো যত নিষ্ঠুরতার খেলা। শুধু আমাদের দেশ সংকটে আছে তা নয়, গভীর সংকট, উৎকণ্ঠা ও হতাশার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী আজ দিন পার করছে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের আনন্দের মুহূর্তে দুর্দশাগ্রস্ত নিপীড়িত মজলুম মানবতার কথাও আমাদের ভাবতে হবে। কিভাবে একটি সুখী সমৃদ্ধ মানবতাবাদী বিশ্ব গড়া যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে জাতীয় ও বিশ্বনেতৃত্বকে। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা নয়, চারপাশে চোখ মেলে তাকাতে হবে আমাদের। অভাবী, দুঃখক্লিষ্ট নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই যে ঈদের আসল শিক্ষা তা আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি অশ্লীল ভোগসর্বস্ব আনন্দ উৎসবে মত্ত না হয়ে নিগৃহীতদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ঈদ পালন করা প্রয়োজন। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের মাধ্যমে ধনী-গরিব সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হোক। বিভেদ বিদ্বেষ ভুলে গড়াগড়ি-কোলাকুলিতে কাটুক এই দিন। প্রতিবছর রোজার দিন পনেরো আগ থেকে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়। ঈদ কাছাকাছি আসতে থাকলে কেনাকাটা বাড়তে থাকে। চলে চাঁদরাত পর্যন্ত। দুই ঈদ ঘিরে পোশাক, জুতা, প্রসাধনী, জুয়েলারি, ঘর-গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হয়। করোনার কারণে প্রতিবছরের চিরচেনা চিত্র এবার নেই। জেলায় জেলায় চলছে লকডাউন। বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ দোকানপাট। কিন্তু এবার ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করোনা সংক্রমণরোধে গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। জেলায় জেলায় দেওয়া লকডাউন কবে খুলবে তার সময়সীমা দেওয়া হয়নি। একজন বিক্রেতার জন্য অন্য জেলায় গিয়ে মালপত্র সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এতে দোকানপাট খুললেও শহরে গিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কেনাকাটা করা সম্ভব হবে না। তাই এবারের ঈদে বাণিজ্য করে মুনাফা করা দূরে থাক, পুঁজি ফেরত পাওয়াও কঠিন হবে। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। এই ব্যাধির কারণে এবারের ঈদ বাণিজ্য সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এক্ষেত্রে কারো কিছু করার নেই। ঈদকেন্দ্রিক বড় বাণিজ্যের জন্য এদেশের ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী ঈদের প্রায় ছয় মাস আগ থেকে পণ্য তৈরি প্রস্তুতি শুরু করেন। ভালো বাণিজ্যের আশায় ঈদের পণ্য বানাতে অধিকাংশ ব্যবসায়ী পুঁজির প্রায় সবটা বিনিয়োগ করে থাকেন।এবার করোনাব্যাধি আঘাত হানে ঈদের মাস দুই আগ থেকে। ব্যবসায়ীদের মরণব্যাধির বিষয়ে আগেভাগে জানা সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে ঈদকেন্দ্রিক অধিকাংশ পণ্য তৈরি হয়ে যায়। এতে বিক্রি করতে না পারলেও নিজস্ব পুঁজির অনেকটা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে লোকসানে রয়েছেন ছোট মাপের ব্যবসায়ীরা।ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের নারী ব্যবসায়ীরা পণ্য বানিয়ে শহরে বড় বড় দোকানে নিয়ে বিক্রি করেন। পরিবহন বন্ধ থাকায় তাঁরা পণ্য নিয়ে যেতে পারছেন না। আবার লকডাউন থাকায় পণ্য নিয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব। ঈদে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পোশাক। পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা হয়। ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষ সাধ্যমতো ঈদে পছন্দের পোশাক কিনে থাকে। ঈদের দিনে নতুন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে কেনা হয় নতুন জুতা-স্যান্ডেল। এজন্য ১০ রোজার পর থেকে জুতা স্যান্ডেলের বিক্রি বাড়ে। ফুটপাতের দোকান, ফেরিওয়ালার ফেরি থেকে নামিদামি বিপনিবিতানেও কেনাকাটার ধুম পড়ে। কেবল পোশাক আর জুতা-স্যান্ডেলই নয় অনেকে প্রসাধনী, জুয়েলারিসহ অন্যান্য শখের জিনিসও কিনে থাকে। অনেকে ঈদ উদযাপনে বাসাবাড়ি সাজাতে নতুন পণ্য কিনে থাকে। এর মধ্যে বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, সোফা, ডাইনিং টেবিল থেকে রান্নার জিনিসও থাকে। এসময় টুপি, আতরের বিক্রিও বেড়ে যায়। ঈদ সামনে রেখে সাধারণ মানুষের চলাচল বেশি হয়। এতে পরিবহন খাতেও আয় বাড়ে। ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা বাড়ায় সমগ্র অর্থনীতিতে গতি আসে। প্রতিবছরের মতো পরিস্থিতি এবারে না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া করোনার কারণে মানুষ ঘরের বাইরেই আসছে না। করোনা অত্যন্ত ছোঁয়াচে ব্যাধি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার পরে বাসা বাড়ির বাইরে বের না হতে সরকারি নিষেজ্ঞাধা দেওয়া হয়েছে। এক এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় প্রবেশ আটকাতে বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। এবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঈদের মতো বড় ধর্মীয় উৎসব হতে যাচ্ছে। করোনার মতো মহামারির মধ্যে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা করা সম্ভব নয়। করোনার জন্য এবারের ঈদে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। অল্প সময়ের মধ্যে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের যে ধরণের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রোজা পালন করতে হবে, তার নজীর ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মুসলিমরা এবার প্রথামত আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশিদের নিয়ে সন্ধ্যায় ইফতারি করতে পারবেন না এবং রাতে দল বেঁধে মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ পড়তে পারবেন না। এমন এক পরিস্থতি অতীতে কখনো হয়েছে আমার জানা নেই, ন্যাশনাল ইউনিভার্টি অব মালয়েশিয়ার গবেষক ফাইজাল মুসাকে উদ্ধৃত করে বলছে আল জাজিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গেছে, অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, কিন্তু অতীতের কোনো লেখালেখিতে বা সাহিত্যে বর্তমান পরিস্থিতির মত কিছু পাওয়া যায়না। যুদ্ধের সময়, দুর্যোগের সময়েও মুসলমানরা রমজানের সময় একসাথে হয়ে তাদের ধর্মীয় আচার পালন করেছে। ব্রিটেনে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংগঠন মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন এক বিবৃতিতে বলেছে, “এবারের রমজান হবে মুসলমানদের জন্য একদম ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, এবং পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সন্দেহ নেই এবারের রমাজন মাস হয়তো মুসলিম ইতিহাসে একেবারে ভিন্ন, ব্যাতিক্রমী ঘটনা হিসাবে জায়গা পাবে। ধর্মীয় আচার পালনে দিক-নির্দেশনার জন্য মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশ যে দেশটির দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই সৌদি আরব রমজান উপলক্ষ্যে বিধিনিষেধ কিছু শিথিল করেছে। সৌদি বাদশাহ মক্কা ও মদিনায় মুসলমানদের দুই পবিত্রতম মসজিদে তারাবি নামাজের অনুমতি দিয়েছে বলে রিয়াদ থেকে রয়টরস বার্তা সংস্থা জানিয়েছে তবে সাধারন নামাজিরা যেতে পারবেন না। এছাড়া, সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে জারী করা কারফিউ সকাল ৯টা থেকে বিকলে পাঁচটা পর্যন্ত কিছুটা শিথিল থাকবে। তবে বিশ্বের বহু মুসলিশ দেশে সেই ছাড়টুকুও দেয়া হচ্ছেনা। মিশরে রমজান মাসে জামাতে নামাজসহ যে কোন ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ। ইরানে আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই রমজান মাসে জনগণকে জামাতে নামাজ না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ আল আকসাতেও রমজানে নামাজ হবেনা শুধু দিনে পাঁচবার আজান হবে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সিঙ্গাপুর, ব্রুনেইতেও এখন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার ওপর যে বিধিনিষেধ চলছে, রমজান মাসে তার কোনো ব্যাতিক্রম হবেনা।যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া এখন বন্ধ, এবং রমজান মাসে তার কোনো ব্যাতিক্রম এবার হবে-কোনো ইঙ্গিত নেই। ব্রিটেনে মসজিদগুলো রোজার সময় নামাজ, দোয়া-দরুদ, খুতবা ভিডিওতে লাইভ-স্ট্রিমিং করবে। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন রমজান উপলেক্ষে জন্য যে পরামর্শ জারী করেছে তাতে বলা হয়েছে-জামাতে নামাজ হবেনা, মসজিদের গিয়ে তারাবি হবেনা, এবং কোনো ইফতার পার্টি করা যাবেনা। পাকিস্তান কিছুটা ব্যাতিক্রমী অবস্থান নিয়েছে। সেদেশে রোজার সময় তারাবি নামাজ অনুমোদন করা হয়েছে, তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে নামজিদের একজনের সাথে আরেকজনের ছয় ফুট ব্যবধান রাখতে হবে। রমজান উপলক্ষে মিশরের রাজধানী কায়রোর বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায় আলোক সজ্জা শুরু হয়েছে, কিন্তু রমজানে কঠোর বিধি-নিষেধ থাকবে সেদেশে। রোজার শেষে মুসলমানরা কি এবার তাদের সেবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ইদুল ফিতর প্রথাগতভাবে উদযাপন করতে পারবে? এখনও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের যে গতি-প্রকৃতি তাতে ইদ উদযাপন কেমন হবে-তা নিয়েও বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। সৌদি গ্রান্ড মুফতি পাঁচদিন আগে ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবারের ইদের নামাজও ঘরে বসে পড়তে হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় ইদের আগে শহর থেকে যে লাখ লাখ মানুষ তাদের গ্রামে যায়, তা এবার নিষিদ্ধ থাকবে।মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও তার দেশে একই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাছাড়া, পুরো রমজান মাস ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রাস্তায় যে মেলা হয়, তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঈদ শব্দটি আরবি। শব্দ মূল আউদ,এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ মানেই পরম আনন্দ ও খুশির উৎসব। প্রতিবছর দু’দুটি ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের ফল্গুধারা। এ দু’টি ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের প্রভাব, ব্যাপ্তি মুসলিম মানসে ও জীবনে বহুদূর বিস্তৃত। পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির প্রতি সত্যিই মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত ও পুরস্কার। মুসলিম উম্মার প্রত্যেক সদস্যের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, মমতা ঈদের এ পবিত্র ও অনাবিল আনন্দ উৎসবে একাকার হয়ে যায়। আর মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। মানুষের জীবনব্যবস্থা থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সংস্থান নেই। আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য ঈদুল ফিতর আনন্দময় দিন। এছাড়াও ঈদ মোবারক শব্দটি মুসলিমদের একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছাবাক্য যেটি তারা ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহায় পরস্পরকে বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হল ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। তাই আসুন, ঈদের নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনে-প্রাণে; বুকে বুক মিলিয়ে চলুন সবাই সবার হয়ে বলে যাই,ঈদ মোবারক আস্-সালাম। লেখক ও কলামিস্ট raihan567@yahoo.com