মহান বিজয় দিবস আজ

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৪২:০৮,অপরাহ্ন ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ | সংবাদটি ২৪০ বার পঠিতবাঙালি মুসলমান জাতিগত বিচারে কতটা ইতিহাস অসচেতন, কতটা হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত, তার বর্তমান রাজনীতি ও কিছু ঘটনা এমন সত্যই তুলে ধরে। চল্লিশের দশকের সম্প্রদায়গত হীনম্মন্যতা ১৯৪৭ সালের আগস্টে তাকে দেশ বিভাগ নিশ্চিত করে স্বতন্ত্র নব্য ভুবন পাকিস্তান গঠনে তাড়িত করেছিল, সে বোধ একাত্তরে পাকিস্তান বিভাজনের পরও সমাজ ও রাজনীতি থেকে পুরোপুরি দূর হয়নি। জনগোষ্ঠীর বড়সড় একটি অংশ এখনো পাকিস্তানবাদী চেতনা ধারণ করে আছে। বলতে হয়, এক অবিশ্বাস্য ঘটনা!
এ ক্ষেত্রে ইতিহাস চেতনার অভাব এতটা প্রকট যে, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সংঘটিত বর্বর ঘটনাবলি আমরা ভুলে গেছি অথবা সেসব আদপেই আমাদের চৈতন্যে গভীর দাগ কাটেনি। কাটলে লাখ লাখ মৃত্যুর ও কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জতের দাম রাজনৈতিক অঙ্গনে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াত না। অনায়াসে আমরা নানা উপলক্ষে পাকিস্তানপ্রীতির প্রকাশ ঘটাতে পারতাম না।
পাকিস্তান কিন্তু এদিক থেকে তাদের পূর্ব অবস্থানে জবরদস্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা একাত্তরে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালি গণহত্যাকে এখনো সঠিক মনে করে এবং করে বলেই আন্তর্জাতিক বিবেচনায় স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধের পক্ষে অবস্থান নিতেও কুণ্ঠিত নয়। অপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের বিচার দূরে থাক, তাদের সহযোগী বাঙালি ঘাতক-দালাল তথা রাজাকারদের বিচারও তাদের কাম্য নয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা তেমন প্রমাণই দেয়।
প্রসঙ্গত, তুলনা টানতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি ও ইহুদি জাতি চেতনার উল্লেখ করতে হয়। সত্যই তারা ইতিহাসসচেতন ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠী। তাই তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ন্যুরেমবার্গ বিচারে সন্তুষ্ট থাকেনি। ইহুদি ঘাতক নাৎসি অপরাধীদের দীর্ঘ সময় পরও বিস্ময়কর শ্রমনিষ্ঠায় খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আইখম্যানের মৃত্যুদ- তার প্রমাণ।
এ বিষয়ে ইউরো-মার্কিন পরাশক্তিকে প্রতিবাদ জানাতে বা ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায়নি। কারণ ইসরায়েল তোষণ তাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা বিদেশনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অথচ তারাই একাত্তরের স্থানীয় ঘাতকদের মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলতে দ্বিধা করছে না। এমনকি একাত্তরে গণহত্যায় অপরাধী পাকিস্তানি সেনা বা সেনানীদের বিচার তাদের অভিপ্রেত ছিল না, যেজন্য তখন সুনির্দিষ্ট অপরাধে যুক্ত পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। শিবির-বিভক্ত বিশ্বরাজনীতির এমনই মহিমা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। অথচ সার্ব যুদ্ধাপরাধীর বা অনুরূপ বিচারে তাদের আপত্তি দেখা যায় না।
সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির এ-জাতীয় মহিমার সঙ্গে আমাদের জাতীয় চেতনার হীনম্মন্যতা সমান্তরাল যাত্রায় শরিক। একই কারণে স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তান প্রশ্নে বাঙালির পাকিস্তানি আমলের বেতসবৃত্তিসুলভ হীনম্মন্যতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, হোক তা ক্রিকেট খেলায় বা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক অঙ্গনের কোনো ঘটনায়। সম্ভবত এসব কারণে আইয়ুব খান থেকে পাকিস্তানি জেনারেলদের আত্মজীবনীতে বাঙালি হীনবীর্য-আত্মমর্যাদাহীন জাতি হিসেবে অবজ্ঞার সঙ্গে চিত্রিত। এটা বাঙালির যোগ্য পাওনা।
রাজনীতিতে-রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মীয় চেতনা বাঙালি মুসলমানকে এমন নির্বীর্য করে রেখেছে যে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের প্রতিবাদী চেতনা ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ যেন এক অবাস্তব স্বপ্ন বা ফ্যান্টাসি বলে মনে হয়। সেসব চেতনার বিন্দুমাত্র বাঙালির জীবনে অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। সমাজের বৃহত্তর অংশে এমন চেতনার প্রতিফলনই লক্ষ করার মতো। ব্যতিক্রমীরা সংখ্যালঘু।
তাই ১৬ ডিসেম্বর তথা বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয়তার চেতনা বা স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিচার কিংবা কাটা-ছেঁড়ায় সেসবের শুদ্ধতা নিয়ে, বিশ্বাসের ভিত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সত্যই কি আমরা বিশ্বাসের সত্য থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলাম, নাকি চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে জান বাঁচানো তথা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হাতিয়ার হাতে তুলে নিয়েছিলাম? সাতচল্লিশের চেতনাকে কি আমরা সত্যই নির্বাসনে পাঠাতে পেরেছিলাম, নাকি এর বিপরীত ব্যাখ্যাই সত্য?
গত ফেব্রুয়ারিতে আমরা টিভি ও সংবাদপত্রে ভাষা-সংগ্রামের নানাদিক নিয়ে অনেক কথা শুনেছি ও পড়েছি। এখন স্বাধীনতার নামে কৃষ্ণচূড়ার অনুষঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের বর্বরতার বিবরণ শুনতে শুনতে যন্ত্রণাবিদ্ধ হই। তখনই মনে হতে থাকে এসব ঘটনা কি আদৌ ঘটেছিল? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে এখনো বেঁচে। তাদের যন্ত্রণার উদ্গার নানা ভাষ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মদানের কাহিনি শুনে আমরা অভিভূত হই, বীরাঙ্গনাদের লাঞ্ছনায় মর্মাহত হই। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হলো, এসব আমাদের চেতনায় আলতো দাগ কেটে মাসান্তে মিলিয়ে যায়। জাতীয় চেতনায় এমন কোনো দৃঢ়প্রত্যয় জন্ম নেয় না, যে প্রত্যয় জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় আমাদের প্রতিবাদী করে তুলতে পারে। ভাষিক জাতিরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তৈরিতে আমাদের দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে পারে।
এসব দিকে আমাদের চৈতন্যে ঘাটতি অনেক। তাই ঘাতক রাজাকারদের অপরাধের বিচারে আমরা রাজনৈতিক মত বা দল নির্বিশেষে একাট্টা হতে পারিনি। শুধু না পারার অক্ষমতাই নয়, বরং তাদের বিচারের বিরুদ্ধে বা শাস্তির বিরুদ্ধে রাজনীতির একাংশকে সোচ্চার হতে দেখা যায়। এমনকি সে উপলক্ষে নিরপরাধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, সাতচল্লিশের ভূত ও পাকিস্তানি প্রেত এখনো আমাদের জনগোষ্ঠীর একাংশের কাঁধে ভর করে আছে।
বাহাত্তরে বৃথাই একটি সেক্যুলার সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। সে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমাদের রাজনীতি এতই দূষিত, এতই বিভক্ত হয়ে উঠেছে যে, জাতীয়তার মূল শেকড়টিতে সেচ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পাল্টা সেখানে চলেছে অযৌক্তিক কাটাকুটি। মূল জাতীয় স্বার্থের বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তো এক অসম্ভব ঘটনা।
আর সেজন্যই একাত্তরের ঘাতকদের বিচার উপলক্ষে টানা সহিংসতার ঘটনা দেখা গেছে মাসের পর মাস, বাসে পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ নিরপরাধ মানুষ, একইভাবে ককটেল বিস্ফোরণে মৃত্যু, গুলিবিদ্ধ পুলিশ বা নিরীহ পথচারীর মৃত্যু, পরিবহন ব্যবস্থা অচল ও ঘাতকদের নির্দেশ অমান্যকারী ট্রাকে আগুনের কারণে নিরীহ অবলা প্রাণীর মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ তার সেক্যুলার পথ পরিহার করে পাকিস্তানের পথে যাত্রা করতে ইচ্ছুক। অবশ্য সর্বসম্মতিক্রমে নয়। কিন্তু পাকিস্তানবাদীদের শক্তিও তুলনায় কিংবা পরিমাপে নেহাত কম নয়। এ সত্য কি আমরা বুঝতে চেয়েছি?
বাংলাদেশি রাজনীতি ও সমাজচেতনার বিচারে এমন অপ্রিয় সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা শেষে বিজয়ের পরও বাঙালি মুসলমানের বৃহদাংশে জাতীয় চেতনা পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। মনের গভীরে সে তলানি রয়ে গেছে। তাই নানা উপলক্ষে সে তলানি ভেসে ওঠে। ঘটায় নানা অবাঞ্ছিত অঘটন।
এসব ঘটনা তাৎক্ষণিক নয়, দু-চার বছরেরও নয়। গত চার দশকে সংঘটিত নানা ঘটনা প্রমাণ করছে যে, আমাদের জাতীয় চেতনা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেনি। শুদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ আমাদের মধ্যে ঘটেনি। সাতচল্লিশের পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের অনেকে পুরোপুরি বর্জন করতে পারেনি। ষাটের দশকের শেষ দিকে বাঙালিয়ানার যে জোয়ার বয়ে যায়, তার প্রভাব ছিল বহিরঙ্গে, তার সঙ্গে অন্তরের গভীর যোগ ছিল না। থাকলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে সুশাসনের অভাব ঘটত না, সংখ্যালঘু কারো কারো বিষয়-সম্পদ জবরদখলের ঘটনা ঘটতে দেওয়া যেত না। এমনকি অতিদ্রুত পাকিস্তানপন্থি স্লোগান উচ্চারিত হতো না, জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা আগমন উপলক্ষে পাকিস্তান জিন্দাবাদ-ভুট্টো জিন্দাবাদ শোনা যেত না। এমন বহু ঘটনা আমাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন জানায়।
এমনকি স্বাধীনতাযোদ্ধাদের হাত দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বা ঘাতক জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিক-সামাজিক পুনর্বাসনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা সত্য হয়ে উঠত না। জাতি বিভাজিত হতো না পাকিস্তানবাদের আলখাল্লায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটিয়ে বিশেষ করে যে রাষ্ট্রে মুসলমান জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং যেখানে সংখ্যালঘুর বাস্তুত্যাগ নানা তাড়নায় এখনো বন্ধ হয়নি।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় এখনো তাই শুদ্ধ অর্জনের অপেক্ষায়। দূষিত রাজনীতি, স্বার্থপর রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা শুদ্ধ গণতান্ত্রিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। পাকিস্তানি চেতনার ভূত তাকে তাড়া করে ফিরবে। তাহলে কি মনে করতে হবে সাতচল্লিশের গভীরতা একাত্তরের চেয়ে বেশি?