বাইডেন যুগে সম্ভাবনার মধ্যপ্রাচ্য

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৫:২৫,অপরাহ্ন ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ | সংবাদটি ৪২৫ বার পঠিতদুই হাজার একুশ সালের জানুয়ারিতে জো বাইডেন সরকারের সম্ভাব্য ক্ষমতায় বসার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততার কমতি নেই। পররাষ্ট্রনীতিতে অভিজ্ঞ পন্ডিত ও সাবেক কর্মকর্তাদের একটি দল এখন জো বাইডেন কীভাবে ট্রাম্প-উত্তর একটি পররাষ্ট্রনীতির নকশা তৈরি আর তা প্রয়োগ করতে পারেন, সে নিয়ে কাজে ব্যস্ত। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের সলাপরামর্শের কেন্দ্রীয় বিষয় কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য নয়। বস্তুত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দল নির্বিশেষে মার্কিন নেতারা এ পরামর্শই দিয়ে আসছেন যে, ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা তথা কমিয়ে আনার সময় এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে, যুদ্ধ শেষ হলে বিজয়ী মিত্ররা শুধু একটি শর্তযুক্ত শান্তি আরোপ করবে, আত্মসংকল্প অস্বীকার করবে এবং আরো ম্যান্ডেট আরোপ করবে, সম্ভবত ট্রাস্টিশিপের ছদ্মবেশে। তার মতামতের খুব বেশি হেরফের দেখা যায় না। তুরস্ক ও ইরানের অবস্থান ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষভাবে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক নীতিগুলোর জন্য বিশ্ব মূলত নির্ভর করে মার্কিনদের ওপর। নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও এ অঞ্চল ঘিরে নীতিতে আমূল পরিবর্তন কখনই খুব একটা লক্ষ করা যায় না। এবারেও হয়তো তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু নীতি জো বাইডেন যে পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন—এ বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট।
আমেরিকায় জো বাইডেনের জয়ী হওয়া, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রশ্নে ইসরায়েলবিরোধী আরব জনমত সৃষ্টি, ইরানের আগ্রাসী ধরনের নীতি পদক্ষেপে কিছু আরব দেশের বিপন্নতা ইত্যাদি নতুন মেরূকরণের সূত্রপাত ঘটাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরমধ্যে তার কিছু প্রাথমিক সংকেতও সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মার্কিন বলয়কে সর্বাত্মকভাবে মোকাবিলার প্রচেষ্টা সব সময় নিয়ে রেখেছে চীন। এর অংশ হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে একটি কৌশলগত সমঝোতা গড়ে তুলেছে। ইরানের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। এই সমঝোতার অংশ হিসেবে চীন জ্বালানির বড় অংশ নেবে ইরান থেকে। সেই সঙ্গে ইরানে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে আর সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি রাখবে। এই সমঝোতার
অনুল্লিখিত দিকটি হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কাজে লাগিয়ে বেইজিং তার আধিপত্য বিস্তার ও সংহত করার প্রচেষ্টা নেবে। ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর থেকে এর বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলোর বৈরিতা ছিল লক্ষণীয়। এর অংশ হিসেবে বিপ্লবোত্তর ইরানে ব্যাপক অন্তর্ঘাতী ঘটনা ঘটে, ইরাক-ইরান দশকব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরান বিপ্লব রপ্তানির ঘোষণায় রাজতান্ত্রিক উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে আতঙ্কিত প্রতিরোধ প্রয়াস লক্ষ করা যায়, যা অনেক সময় জাতিগত ও রাষ্ট্রগত প্রতিহিংসা পদক্ষেপ পর্যন্ত গড়ায়। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের পথ ধরে গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ভাঙচুর ও মেরূকরণের সৃষ্টি হয়।
এবং এই মেরূকরণে ইরানের দৃশ্যমান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় একই সঙ্গে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এবং ইসরায়েল। লক্ষ্য নির্ধারণের মাত্রায় ইরানের সামনে ইসরায়েলের চেয়েও তাৎক্ষণিক প্রতিপক্ষে পরিণত হয় উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, বিশেষত সৌদি আরব। এ দিকে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তায় সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমতে থাকে। ওবামা-বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে একনায়ক শাসিত দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতি সমর্থন দেয় একপর্যায়ে। এর ফলে আরব বসন্তের জের ধরে একাধিক আরব একনায়কের পতন ঘটে। সৌদি আরবসহ বেশ কিছু আরব দেশের রাজতন্ত্র হুমকিতে পড়ে যায়। গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্য ভূমিকা নেন তুরস্কের এরদোয়ান। এই পরিস্থিতিতে আরব শাসকদের বেশির ভাগ এবং ইসরায়েল ইরানের চেয়েও তুরস্ককে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। আর মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে এই শক্তিটিকে দমন করার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। মিসরে মুরসির নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সিসির সামরিক অভ্যুত্থান এবং পরে ব্রাদারহুডের ওপর গণহত্যার মতো নির্বিচার দমনপীড়ন, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পর রাশিয়ার বিমান আক্রমণ ও ইরান সহায়তাপুষ্ট হিজবুল্লাহর অভিযানে একবারেই তিন লাখ সিরীয় নিহত হওয়া এবং লিবিয়ায় খলিফা হাফতারকে দিয়ে রাষ্ট্র দখলের প্রচেষ্টার সঙ্গে এর যোগসূত্র রয়েছে। এরমধ্যে জো বাইডেনের আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে থাকে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল লবি আইপ্যাকের সঙ্গে জো বাইডেনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। তার বর্তমান স্ত্রীও একজন ইহুদি। তিনি গত ১৩ আগস্ট ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণীকরণ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যের গভীর বিভাজনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সহায়তা করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকে সাহসী কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তদুপরি, এমন কোনো লক্ষণ নেই যে, বাইডেন প্রশাসন এই চুক্তিগুলোর (বাহরাইন এবং সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্ব অনুসরণ করেছে), ধারাবাহিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। তবে উদার চিন্তা চেতনার নেতা জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র ধরনের ইসরায়েলবান্ধব নীতি থেকে সরে আসতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি জবরদস্তি কোনো সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে আরব ইসরায়েল একটি সমাধান চাইবেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ট্রাম্প এরদোয়ানের প্রতি তার শ্রদ্ধা গোপন করেননি, বাইডেন প্রকাশ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করেন, যা তুরস্কের রাজধানীতে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ট্রাম্পের থেকে ভিন্ন, বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই তুরস্কের মানবাধিকার পরিস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করবে, কারণ তিনি ওবামা প্রশাসনের অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার এক সফরে তুরস্কে বেশ কয়েকজন ভিন্নমতাবলম্বীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
আগামী সময়ে ওয়াইপিজির সঙ্গে ওয়াশিংটনের অংশীদারত্ব আরো তীব্রতার সঙ্গে সহ্য করবে, যদিও এই ক্ষেত্রের পরিস্থিতিতে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাদেরকে সিরিয়ার ওপর একটি নতুন ভারসাম্যের ব্যাপারে আপস করতে হবে। বাইডেন প্রশাসনের এজেন্ডার একটি তাৎক্ষণিক বিষয় হতে পারে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা। এই দুই সংস্থার সঙ্গে তুরস্কের বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক, তাই তুরস্কের স্বার্থের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয়, সিরিয়া, ককেশাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে। কোনো সন্দেহ নেই, তুরস্কের এস-৪০০ ক্রয় এবং তাদের পরীক্ষা আগামী সপ্তাহগুলোতে আঙ্কারা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক দখল করবে এই উদ্বেগের সঙ্গে যে কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সক্রিয় করা হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্কের বিষয়ে নতুন কী থাকবে জো বাইডেনের নীতিতে, তা দেখতেই মুখিয়ে বিশ্ববাসী। তবে সৌদি আরবের অবস্থান, সঙ্গে ইরান আর তুরস্কের প্রতি মার্কিনদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমার আকর্ষণ সব থেকে বেশি। সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো পরিকল্পনা কি থাকতে পারে কি না বাইডেন প্রশাসনের, এ ব্যাপারেও যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। তবে শুরুতেই আগ্রাসী কোনো পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের দিকে তারা যাবে না, কেননা করোনা মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধার তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে বলে ধারণা করা যায়। তবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ওপর নতুনভাবে জোর দেওয়া হলে মধ্যপ্রাচ্য বাইডেন প্রশাসনকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
এমনকি এটি তিউনিসিয়া, মরক্কো এবং জর্ডানের মতো স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। নতুন মার্কিন সরকারের জন্য লেবাননও কিছু কাজ দেখানোর সুযোগ করে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সমস্যাক্লিষ্ট দেশটিকে আস্থা পুনরুদ্ধার এবং প্রশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু বড় ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারবে। ইরানও বাইডেন প্রশাসনের জন্য হবে এক কঠিন পরীক্ষা। কেবল ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে মার্কিন অঙ্গীকার পুনরুদ্ধার করাই যথেষ্ট হবে না। বাইডেনের পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এই চুক্তিতে সংশোধনী প্রস্তাব আনার এবং মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে মিলে এটি রক্ষা করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে। অন্যদিকে ইরানের আঞ্চলিক আচরণ দেখভালের দায়িত্ব হবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগের আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে সিরিয়ার ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতা সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দ্রুত কোনো কূটনৈতিক সাফল্য পাওয়ার অনুকূল নয়। সিরিয়াকে ঐতিহাসিকরা সম্ভবত দেখবেন বারাক ওবামার সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতিগত ব্যর্থতা হিসেবে। এহেন দেশটিতে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে কিছু করার আছে কি না, তা বাইডেনকে দেখতে হবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের এই সম্ভাব্য মেরূকরণের সঙ্গে সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির যোগসূত্র থাকতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট
raihan567@yahoo.com