সড়ক ভাড়া দিয়ে দিনে ১৪ লাখ টাকা পকেটে

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১৯:০১,অপরাহ্ন ২১ ডিসেম্বর ২০২০ | সংবাদটি ২১৪ বার পঠিত*আড়তদারের হাত হয়ে টাকা যায় সমিতিতে
*ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে তিন পালায় ২৪ ঘণ্টাই ভাড়া থাকে সরকারি সড়কটি
*ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানেন, তবে বন্ধ করতে আগ্রহী নন
রাত সাড়ে ৯টার দিকেই কারওয়ানবাজার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের (এসটিপি) সামনে ফুটপাত ও রাস্তার ওপর থেকে কাঁচামালের দোকানগুলো ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন দোকানিরা। টুকরিতে করে কাঁচামাল বিক্রি করেন আবদুল হানিফ। তড়িঘড়ি করে দোকান গোটানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন বড় বড় ট্রাক আইব। আমাদের এ সময় পর্যন্ত বসতে দেওয়া হয়। বড় ট্রাকের মাল নামব এইহানে। দোকান না সরাইলে আড়তদাররা ঝামেলা করে।’ গত শনিবার রাতের চিত্র এটি। হানিফ জানান, প্রতিদিন বিকাল ৪টার পর থেকে টাকার বিনিময়ে রাস্তার পাশে দোকান পেতে বসেন তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মুলা আর মিষ্টিকুমড়াভর্তি তিনটি ট্রাক এসে থামে। ট্রাক থেকে ওইসব কাঁচামাল নামাতে নির্দেশনা দিতে থাকেন আড়তদাররা। মুলা ও মিষ্টিকুমড়া নামিয়ে তা সড়কের ওপর স্ত‚প করে রাখা হয়। এর কিছুক্ষণ পরই শালগম ও পেঁয়াজভর্তি ট্রাক আসতে শুরু করে। আড়তদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার মালগুলো নামার পর এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। এজন্য রাস্তার ভাড়াও দেন তিনি। ভাড়া কে নেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো জানেনই।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই সড়কটিতে জট লেগে যায় মালবাহী ট্রাকে।
এর আগে ১১ ডিসেম্বর বিকাল ৪টার দিকে একই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিজের ভ্রাম্যমাণ দোকানটি দ্রত গুটিয়ে নিচ্ছিলেন ফল বিক্রেতা জলিল মিয়া। কিছুক্ষণ আগে থেকেই অনেক কম দামে বেচতে থাকেন দোকানের ফল। কারণ তার দোকানের জন্য বেঁধে দেওয়া সময় ফুরিয়ে আসছিল। এসটিপির কাছে রাস্তায় কথা হয় জলিল মিয়ার সঙ্গে। জানা গেল, তিনি দৈনিক ৮ ঘণ্টার জন্য ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে থাকেন। ওই দিন বিকাল ৪টা বাজতেই ভ্যানে করে বড় হাঁড়িভর্তি হালিম নিয়ে হাজির হন রুবেল। জলিল মিয়ার ছেড়ে দেওয়া জায়গায় বসেন রুবেল। তিনি রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানকার ভাড়াটিয়া। তিনি জানান, প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার জন্য ৬০০ টাকা ভাড়া দেন। তার কাছ থেকে ভাড়া নেন আড়তদাররা। রাত ১০টা বাজতেই তিনি দোকান বন্ধ করে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে সবজিভর্তি ট্রাক। পরবর্তী ৮ ঘণ্টার জন্য ওইখানকার ভাড়াটিয়া হলেন সবজির ব্যাপারী জাবেদ মিয়া। তার সবজি ও পেঁয়াজের তিনটি ট্রাক এসেছে। তিনি জানান, দৈনিক (৮ ঘণ্টার জন্য) ১ হাজার টাকা করে ভাড়া দেন। কাকে ভাড়া দেন জানতে চাইলে মৃদু হেসে রুবেল বলেন, ‘এখানকার নেতারা এই ভাড়া নেন।’
এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারওয়ানবাজারে জনতা টাওয়ার নামে পরিচিত সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি) থেকে পেট্রোবাংলা পর্যন্ত সরকারি সড়কটি প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টাই ভাড়ায় থাকে। দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে তিন ধাপে পর্যায়ক্রমে ভাড়া দেওয়া হয় রাস্তার দুই পাশ। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪ লাখ টাকা ভাড়া উঠানো হয়।
তবে ভাড়ার ওই টাকার কোনো অংশই সিটি করপোরেশনের কোনো খাতে যায় না বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে কিছু জানে না পুলিশও।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ওখানকার রাস্তার মূল ভাড়াটিয়া হলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ব্যাপারীরা। সরকারি রাস্তাটির চার থেকে পাঁচ হাত করে এক-একটি দোকান হিসাবে বরাদ্দ থাকে।
কয়েকজন ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই সড়কে দৈনিক কাঁচামালবাহী ট্রাক আসে প্রায় ১০০টি। প্রতিটি ট্রাক থেকে দৈনিক ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে উঠানো হয়। এতে গড়ে ৮ লাখ টাকা ভাড়া উঠে প্রতিদিন।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কারওয়ানবাজারের জনতা টাওয়ার থেকে পেট্রোবাংলার পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ফুটপাতে অন্তত ৫০০ দোকান আছে। সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ফল, কাঁচামাল ও চায়ের দোকানপ্রতি ভাড়া দেওয়া হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। এদের কাছ থেকে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকার বেশি ভাড়া উঠে। বিকালে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পিঠা, হালিম, ঝালমুড়িসহ অন্যান্য খাবারের দোকান এবং ভ্যানে করে শীতবস্ত্র বিক্রির জন্য ভাড়া দেওয়া হয় দোকানপ্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। এতে দিনে সাড়ে তিন লাখ টাকা আদায় হয়।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেন কামাল নামের এক আড়তদার। বিনা ভাড়ায় কেউ বসলে কামাল দল-বল নিয়ে গিয়ে দোকান ভেঙে দেন। কামালের ওপরে রয়েছেন লেবুর আড়তদার আমান। জানা গেছে, আমান কারওয়ানবাজারের যেকোনো স্থানে যাকে তাকে যখন-তখন বসাতে পারেন। তার সামনে কথা বলার সাহস কারওয়ানবাজারে কারো নেই। তবে আমানের ওপরে রয়েছেন ‘কারওয়ানবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি ওমর ফারুক। তাকে বিএসসি ফারুক নামে চেনে সবাই।
সরকারি রাস্তা ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওমর ফারুক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসলে রাস্তা বা ফুটপাত থেকে দলীয় কিছু নেতা এবং প্রশাসনের লোকরা টাকা নেন। এর সঙ্গে আমাদের সমিতির কোনো সম্পর্ক নেই।’ আরেক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে রাস্তায় বা ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে কারওয়ানবাজারে ১০ থেকে ১২টির মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি রয়েছে। সমিতির লোকরা এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হয়ত টাকা নিতে পারেন। আমরাও ব্যবসায়ী, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের থেকে কারা টাকা তোলে তা দেখার বিষয় আমাদের নয়, সময়ও নেই। তাই আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’
চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে জানেন ঠিকই তবে কোনো ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম হাসান বলেন, ‘আমি জানি এ সড়কে চাঁদা উঠে। তাও আমি অভিযানে যাই না। কারণ আমি গেলেই চাঁদার তালিকায় আমার নাম উঠে যেতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘উচ্ছেদ করলেও লাভ হয় না। এ মাসেও দুবার উচ্ছেদ করেছি। একদিকে উচ্ছেদ চললে অন্যদিকে ঠিকই বসে যায়। তবে এই ভাড়ার কোনো অংশ সিটি করপোরেশন এবং কাউন্সিলরের খাতে যায় না।’
ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এই চাঁদার কোনো অর্থই সিটি করপোরেশন পায় না। কারা চাঁদা তোলে আর কাদের পকেটে যায় তা আপনারাও জানেন আমরাও জানি।’ তাহলে ব্যবস্থা কী নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবস্থা নিলে কোনো লাভ হয় না। আমরা সকালে ব্যবস্থা নিলে বিকালে ঠিকই আগের অবস্থানে ফিরে আসে।’
তেজগাঁও থানার ওসি মো. সালাহ উদ্দীন মিয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আগে যেভাবে চলে আসছে সেভাবেই চলছে। তাই কিছু বলতেও চাই না। যারা চাঁদা আদায় করেন, আপনারা তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’