সিলেটে বিনোদন পার্কগুলোর অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৩৫:০৪,অপরাহ্ন ০৭ জানুয়ারি ২০২১ | সংবাদটি ২৭২ বার পঠিতকরোনা মহামারিতে সিলেটের বিনোদন পার্কগুলোর অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে।
সিলেটে প্রকৃতি সৃষ্ট বিনোদন স্পট ছাড়াও মানুষের তৈরী একাধিক বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। তাদের মধ্যে বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান, জাকারিয়া সিটি, ড্রিমল্যান্ড এমিউজমেন্ট ও ওয়াটার পার্ক এবং এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ড হলো শিশু বিনোদনের অন্যতম স্থান। যদিও দক্ষিণ সুরমা এলাকার আলমপুরে চালু হবার অপেক্ষায় রয়েছে শেখ হাসিনা পার্কটি।
করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করে গত মার্চ মাস থেকে দেশের সকল পার্ক, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে বড় অঙ্কের ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ৬ মাস বন্ধ রাখার পর গত সেপ্টেম্বর মাসে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সরকার। এর পর থেকে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করেন এই শিল্পের সাথে জড়িতরা।
সিলেটের প্রাণ কেন্দ্র ধোপাদিঘীর পাড়ে অবস্থিত বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান। ওসমানী শিশু পার্কে নামে ব্যাপক পরিচিত এই পার্কটির ম্যানেজার রুমেল খন্দকার জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর পার্ক খুলেছে ঠিকই কিন্তু দর্শনার্থীর অভাবে পার্কটি খোলা না বন্ধ সেটা বুঝাই মুশকিল। পূর্বের তুলনায় এখন ৫০ শতাংশেরও কম দর্শনার্থী পার্কে আসছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই পার্কটির পরিচালনায় আর্থিক ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
রুমেল জানান, পার্কটির স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ জন স্টাফ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বন্ধ থাকাকালীন সময়ে এদের কেউই বেতন-ভাতা পাননি।
২০০০ সালে স্থাপিত ৮ একর আয়তনের এই শিশুপার্কের চেয়ারম্যান ও ব্যাপস্থাপনা পরিচালক মিফতাহ আজিজ চৌধুরী সুইট অসুস্থ থাকায় বর্তমানে এর দেখভাল করছেন তার ভাই মোস্তাফিজুর রহমান পাপলু। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপ কালে পাপলু জানান, করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় ৬ মাস পার্কটি বন্ধ ছিল। ঐ সময় স্টফদেরকে বেতন-ভাতা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে। কাউকে ছাটাই করা হয়নি, পার্ক খোলার পর সকল স্টাফরা স্ব স্ব পদে যোগদান করেছেন। বর্তমানে তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে পাপলু জানান, স্টাফদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে আর্থিক ঘাটতি মেনে নিয়েই পার্কটি পরিচালনা করতে হচ্ছে। দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণে পার্কটিকে সময় সময় সংস্কার করা হয়। সকল সংকট কাটিয়ে ওসমানী শিশু পার্কটি নগরবাসীর পদচারণায় আবারো সরব হয়ে ওঠবে এমনটাই আশা করছেন মোস্তাফিজুর রহমান পাপলু।
নৈসর্গিক সৌর্ন্দযকে অটুট রেখে প্রায় ১৭ একর পাহাড়ী জমিতে গড়ে ওঠা জেসটেট হলিডে রিসোর্ট তথা জাকারিয়া সিটির বর্তমান নাম এক্সেলসিয়র সিলেট হোটেল এন্ড রিসোর্ট। সিলেটী প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠান এক্সেলসিয়র গ্রুপের মালিকানাধীন এই রিসোর্টে রয়েছে শিশু পার্ক, অডিটোরিয়াম, মিনি চিড়িয়াখানাসহ খেলাধুলা, শরীর চর্চা ও বিনোদনের চমৎকার পরিবেশ এবং বিয়ে-জন্মদিনসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের অনন্য সুযোগ সুবিধা।
সিলেট-তামাবিল সড়কে অবস্থিত এই রিসোর্টটিও সরাকরী নির্দেশনা মোতাবেক ৬ মাস বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও দেখা মিলেনি দর্শনার্থীর কিংবা অতিথিদের। করোনা পরিস্থিতিতে আশানুরূপ দর্শনার্থী না হওয়ায় পরিচালনা ব্যয় নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের।
দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় প্রায় অধিকাংশ কর্মচারীই রিসোর্টটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান বলে জানালেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজামাল নুরুল হুদা। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সচল রাখতে বর্তমানে ২০/২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নতুন উদ্যামে কাজ শুরু করেছেন।
পার্কটি দর্শনার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে জানিয়ে শাহ জামাল বলেন, বিগত বছরগুলোতে শীতের শুরুর দিকে যে হারে দর্শনার্থী ও পর্যটকরা এসেছেন করোনার এই মহামারিতে সেই হারে আসবেন এমনটা আশা করা বোকামি। তবে যেটুকু আশা করেছিলাম সেইটুকুই পূরণ হচ্ছে না। এতে করে বড় একটি আর্থিক সংকট মোকাবেলা করে আমাদের এগোতে হচ্ছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শাহজামাল বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে পার্ক খোলার যে ২৫টি শর্ত দেয়া হয়েছে, আমরা সেগুলো যথাযথ পালন করার চেষ্টা করছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দর্শনার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করছেন। মাস্ক ছাড়া আমরা কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছি না।
শাহ জামাল মনে করেন করোনা মহামারি কাটিয়ে রিসোর্টের নীল পানির সুইমিংপুলে আবারো সাতাঁর কাটাবে মানুষ। স্পোর্টস কমপ্লেক্স-টেনিস কোর্ট-জিমনেশিয়াম আবারো জমে উঠবে, শিশুদের কোলাহলে মুখরিত হবে রাইডগুলোর সাথে চিড়িয়াখানাটিও।
সিলেট এয়ারপোর্ট রোডের নয়নাভিরাম বিনোদন পার্ক অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ড গড়ে উঠেছে প্রায় ১৩ একর ভূমির উপর। পাহাড়-টিলা আর চা বাগানের মনমুগ্ধকর পরিবেশ আগত দর্শনার্থীদের মনকে দোলা দেয় প্রতিনিয়ত। করোনা মহামারিতে দর্শনার্থীর আনা-গুনা কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ব্যয় নিয়ে চাপে পড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডের জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন জানান, দর্শনার্থী আগের তুলনায় এক চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পরদিন অর্থাৎ গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পার্কটি পুনরায় খুলে দেয়া হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৩ মাস অতিবাহিত হলেও দর্শনার্থীর আশানুরূপ আগমন না ঘটায় মাসিক প্রায় ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ের পুরোটাই এখন কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হচ্ছে।
বন্ধ থাকাকালীন সময়ে পার্কের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে জানিয়ে আনোয়ার বলেন, আমাদের ৩৪ স্টাফের মধ্যে ৩ জন চাকুরী নিয়ে বিদেশে চলে যান। প্রতিষ্ঠান কাউকে ছাটাই করেনি।
শিশুদের জন্য ১৩টি রাইড চালু থাকা পার্কটিতে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সরকারী নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছেনা এমন অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, অবশ্যই আমরা জেলা প্রশাসনের বেধে দেয়া ২৫টি শর্ত মেনে চলছি। আমাদের প্রধান ফটকে লেখাই আছে ‘নো মাস্ক, নো এন্ট্রি’। তাছাড়া তাপমাত্রা পরীক্ষা না করে আমরা কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছি না।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার হিলালপুর গ্রামে অবস্থিত ড্রিমল্যান্ড এমিউজমেন্ট ও ওয়াটার পার্কটিতে দর্শনার্থীদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হতো কর্তৃপক্ষকে। বর্তমানে যার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। দীর্ঘ ৬ মাস বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বরে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয় পার্কটি।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়ার্টার পর্কের দায়িত্বে থাকা খায়রুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, সব মিলে ১১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পার্কটি পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। বন্ধকালীন ৬ মাসের মধ্যে ২ মাসের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। এতে করে ২০/২৫ জন চাকুরী ছেড়ে চলে যান।
পার্কটির সচিবের দায়িত্বে থাকা সদরুল হাসান জানান, আয়ের সাথে ব্যয়ের বিস্তর ফারাক। বর্তমানে অর্থনৈতিক ঘাটতি মোকাবেলা করেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ড্রিমল্যান্ড ওয়াটার পার্কটি স্বরূপে ফিরবে এমনটাই আশা করছেন সদরুল হাসান।
লেখক : মারুফ হাসান, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক জালালাবাদ।