একুশ মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫২:২২,অপরাহ্ন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | সংবাদটি ৩১৪ বার পঠিতকে অভিজাত? কেইবা উঁচুদরের মানুষ? যদি মুখের ভাষায় চিনতে চান, তাহলে কীভাবে চিনবেন তাকে? শুদ্ধভাবে বাংলা বললে? না, শুদ্ধ ভাষায় বাংলা বললে তাকে সমাজের উঁচুদরের মানুষ হিসেবে এখন আর বিবেচনা করা হয় না। তাহলে সমাজের উঁচুদরের মানুষ বিবেচনা করার মাপকাঠি কী?
উঁচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে হলে আপনাকে বাংলায় এক বাক্যের কুড়িটি শব্দের মধ্যে ১০টি ইংরেজি বলতে হবে। এভাবে কথা বললে আপনি সমাজের উঁচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে পারবেন। চাই কি ট্রেনবাসের টিকিট কাটতে যাবেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে যাবেন, কোনো সরকারি অফিস-আদালতে যাবেন, সেখানে কাজ উদ্ধার করতে চাইলে আপনাকে এভাবে আধো বাংলা আধা ইংরেজি ভাষায় কথা বলে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি শিক্ষিত ও ক্ষমতাধর মানুষ বটে। এভাবে আধো বাংলা আধে ইংরেজি বলে প্রমাণ করতে হবে আপনি স্মার্ট ও আধুনিক মানুষ। অন্যদিকে শুদ্ধ ও আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলবে কারা। ‘অশিক্ষিত’ কিংবা স্বল্পশিক্ষিতরা। এ অবস্থা ইদানীংয়ের। আর এর আগে?
এর আগেও এ অঞ্চলের কথিত উঁচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে স্মরণ নিতে হতো উর্দু, ফারসি ও আরবির। বলতে হতো, তাদের পূর্বপুরুষ এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ইরান, আরব, তুরস্ক, উজবেকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান। রান্না হবে কাবাব-পরোটা কোরমা-পোলাও। কথায় কথায় ফারসি, উর্দু, তা না হলে তো আর কীসের অভিজাত। তাহলে বাংলা? সে তো নিচু জাতের ভাষা!
তার আগে ‘সংস্কৃতি’ ভাষাজ্ঞান ছাড়া সমাজের অভিজাত প্রমাণ করা যেত না। কথায় কথায় সংস্কৃতি ভাষার স্লোক আওড়ানো ছাড়া জানাশোনাদের কাতারে যাওয়া যেত না। তুলসী দাস, কালীদাস থেকে উদ্ধৃতি দিতে হতো হরহামেশা। আর বাংলার জায়গা তো কেবল ‘মেøচ্ছ’জনের কাছে। সমাজের নিচুস্তরের প্রকৃতজনের কাছে।
এভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণরা বলবে সংস্কৃতি আর আশরাফ মুসলমানরা বলবে ফারসি-উর্দু। নিজের এলাকা চেনার আগে মুসলমানরা চিনবে মক্কা-মদিনা আর বাগদাদ, আর হিন্দুরা চিনবে গয়া কাশি বৃন্দাবন। দেশীয়দের মধ্যে যারা নিজেদের জাতে তুলতে চাইত, তাদের মধ্যে প্রবলরূপে এই প্রবণতা ছিল। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত এবং অনুসরণ ও অনুকরণ করত কথিত অভিজাতদের। যে বাংলা ভাষার কোনো বাপ-মা নেই। এই ক্ষোভে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম গালাগাল করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গেতে জন্মি যে জন হিংসে বঙ্গবানী/ সেজন কাহার জন্ম, নির্ণয় ন’ জানি।’
বোঝা যায় বাংলা কোনো দিনই অভিজাতের দরবারে, জলসা ঘরে কিংবা হেরেমে জায়গা পায়নি। জন্মের পর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে খুবই কম সময়। যক্ষের ধনের মতো, চোখের মণির মতো, হৃদয়ের আকুলতা, ভাবের আবেগ দিয়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছে সাধারণ মানুষ। অন্ততজনই বাংলা ভাষার মা-বাপ। মাতৃগর্ভের শিশুর মতো তারাই নিজ গর্ভে লালন করেছেন, বিকশিত করেছেন বাংলা ভাষাকে।
এই ভাষার জাদু ও অমিত শক্তি রয়েছে। যার সন্ধান পাওয়া গেছে, আরো সন্ধান বকেয়া পড়ে আছে। যে ভাষার পরশে জেগে উঠেছিল তদান্তীন পূর্ববাংলায় জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। যার ধারাবাহিকতায় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, তারপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধ। যে ভাষার গর্ভ থেকে একটি দেশের জন্ম হয়েছে, একটি রাষ্ট্র নির্মাণের দিকে ইতিহাসকে ঠেলে দিয়েছে। সেই ভাষার অমিত শক্তি সহজেই আঁচ করা যায়।
ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন ভাষায় আভিজাত্য খুঁজতে যাওয়ার যে প্রবণতা ছিল পূর্ববাংলার হিন্দু ও মুসলমাদের মধ্যে, তার মুখে প্রথম চপেটাঘাত হানে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। নিজ ভাষার মধ্যে যে মানিক রতন আছে, তার সন্ধান করার তাগিদ দিয়েছে অমর একুশে। বহু আগেই যা উপলব্ধি করেছিলেন মধু কবি। ‘হে বঙ্গজ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বিদেশমুখীনতা থেকে অভিজাত মানুষকে ‘বাংলাদেশে’ ফিরিয়ে আনে। এই ভাষার অমিত তেজের সন্ধান দেয়। জানান দেয়, আমরাও পারি। গর্ব করার মতো ভাষা সংস্কৃতি আমাদের আছে। এজন্য বাইরের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকার দরকার নেই। সেই অর্থে একুশ মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
এর আগে উনিশ শতকে এই ভাষার পরশে জেগে উঠেছিল কলিকাতা। সেই নগরকে ঘিরে এসেছিল বাংলার রেনেসা। বঙ্কিম, মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখরা ছিলেন সেই রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ।
এই ভাষার যে এত শক্তি, এত সৌন্দর্য, তা সত্ত্বেও সেখানে কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এই ভাষাকে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়নি। বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা বাংলায় যে সম্ভব সেটা বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বলে দিয়েছেন। এ ছাড়া বহু বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা এখনো ইংরেজিতে হয়। বাংলা ভাষার সেসব বিষয় এখনো উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়নি। বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার উপযোগী ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার আয়োজন অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ। অর্ধশতক ধরে যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পর এত দিন সেই গ্যাপ পূরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি? তার গ্রহণযোগ্য জবাব খোঁজা দরকার। কারণ এখন তো সবখানেই বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার রয়েছে। কারণ বাঙালি সব ভাষা শিখবে, তার আগে শিখবে বাংলা ভাষা। সম্মান করবে সব ভাষাকে। অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষাকেও দেবে মর্যাদার আসন। মাথা তুলে দাঁড়াক বাংলাদেশ। সেই কাজে হাত দেওয়ার এখনি সময়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
imam.gazzali@gmail.com