‘তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২১:১০,অপরাহ্ন ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | সংবাদটি ৯৫ বার পঠিততীর ভেঙে বসতভিটা তলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে কপোতাক্ষ পাড়ের শিশু-কিশোররা। ভাঙতে ভাঙতে নদ যেদিন ঘরের কাছে এসে ঠেকেছে, সেদিন তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া কিংবা কপোতাক্ষে বিলীন হওয়ার পথে থাকা বাবার কবর শেষবারের মতো দেখতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠা কিশোর-তরুণের ‘অভিযোগহীন রোদনধ্বনি’ কে শুনেছে কবে! যে পথে হেসে-খেলে বেড়িয়েছিল তারা; সেই পথ-প্রান্তরই হচ্ছে বিলীন। ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙেই দেখছে কপোতাক্ষের একূল-ওকূল ভাঙার খেলা। এই খেলা দেখতে দেখতেই যেন ভয়-ডরহীন-সংগ্রামী এখানকার শিশু-কিশোররা। জীবনযুদ্ধে চলছে এগিয়ে। তাদের প্রত্যাশা, উড়ে যাবে অচিরেই আতঙ্ক-উদ্বেগ। কেটে যাবে কপোতাক্ষে ভাঙনের দুর্দিন। ফিরবে আবার সোনালি সুদিন। যেন ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে//তবু শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে’…
রাড়ুলী গ্রামের কল্পনা বিশ্বাস বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদ এখন আগ্রাসীরূপে হামলে পড়েছে আমাদের ওপরে। নদের বাঁধ ভাঙনে আমাদের বাসা চলি যাচ্ছে। দুটি ঘর ছিল। একটি খুলি রাখিছি আর একটি আছে। এমপি ও চেয়ারম্যানরা শুধু দিখি যায়; কিচ্ছু দেই না।’ বিশ্বজিৎ বলেন, ‘আধাআধি ঘর যা আছে সেটা ভাঙনে হারাই যাচ্ছে।’
একজন বৃদ্ধা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ওই দেখতিছেন নদীর মধ্যিই ঘর।’ রাড়ুলীর পূর্ব মালুপাড়ার শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘৮০টি পরিবারের বসতি; সবই ঝুঁকিতে। এখনি বাঁধের কাজ শুরু না হলে বর্ষা মৌসুমি না যেতেই কপোতাক্ষে বিলীন হয়ে যাবে। এখানে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। প্রত্যেকের দু-এক কাঠা করে জায়গা। এতে বিলীন হলে তারা ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে। কেউ পাশে আরেকটি চাল তুলে বাস করছে। এটাকে তো জীবন বলা যায় না।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কল্যাণী বিশ্বাস বলেন, ‘চারখান ঘরের একখান আছে। ভালো নেই বাপু ভালো নেই। পরের জায়গাই ঘর বেনধে আছি। স্থানীয় জয়নাল মেম্বার ১০ কেজি চাল দিসে—এই সাহায্য।’
রাড়ুলী ইউপির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ গুলদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি কয়েকবার বাঁশের পাইলিং করেছি টেকেনি। প্রতি বছর কর্মসূচির আওতায় তীরের ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করি। তবে এরই মধ্যে শতাধিক ঘর চলে গেছে। এখন আশিটি পরিবার আছে। এদের বাঁচাতে হলে পাকা ব্লক ফেলতে হবে।’
স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কাজের ঠিকাদারি এমপির শ্বশুর পাওয়ায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি; পুরো টাকা অপচয় হয়েছে।’
কপোতাক্ষ নদের মাহমুদকাঠি গ্রামের বাসিন্দা ডা. বাসুদেব রায় বলেন, ‘আমাদের এখানে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এক বছর ধরে ভাঙনটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। টিআরের যে বাঁধ ছিল সেটি ভেঙে গেছে। এতে বসতবাড়িতে পানি ঢুকছে। স্থানীয় এমপি, পাউবো এবং ইউএনওকে অবহিত করেছি; তাদের মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি।’
কপিলমণি কলেজের অধ্যাপক বিশ্বাস ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘মাহমুদকাটি গ্রামের মালোপাড়া অধ্যুষিত কপোতাক্ষের ব্যাপক ভাঙনে জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে।’
নৌকার মাঝি দিলিপ হালদার বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রায় ৯ একর এলাকা নদের গর্ভে তলিয়ে গেছে। আমরা পাঁচ পুরুষ ধরে এই খেয়াঘাটে কাজ করছি। নদের বাঁধের কখনো পরিবর্তন হতে দেখিনি। সাতক্ষীরার তালা ও পাইকগাছা দুটি জেলাকে কপোতাক্ষ নদ দিয়ে বিভক্ত থাকলেও জমি মেপে দেখা যায় আমাদের জমি ওই পারে আছে।’
মন্তব্য পেতে স্থানীয় এমপি আখতারুজ্জামান বাবুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সেলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে জানতে চাইলে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম খালিদ হোসেন সিদ্দিক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট এলাকায় এক কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা আছে। বর্ষার মৌসুমের পর সেখানে কাজ শুরু হবে। এ মুহূর্তে ভাঙনকবলিত এলাকায় কোনো উদ্যোগ নিয়ে লাভ হবে না। কারণ কাজগুলো করতে হয় শুকনো মৌসুমে। এর বাইরে করলে সরকারি অর্থের অপচয় হবে। আশা করছি অক্টোবর থেকে কাজ ধরা সম্ভব হবে। আমি প্রতিনিয়ত নজর রাখছি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছি। নদীতে যারা ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রয়োজন হলে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’