বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে

মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৯:৪৬,অপরাহ্ন ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | সংবাদটি ১১৬ বার পঠিতনির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকায় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এবার সর্বশেষ ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দেখা গেছে, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৪৩ জন প্রার্থী। অথচ একসময় ইউপি নির্বাচন হতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তখন দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়া হতো না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়া শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে।
রাজনীতিকসহ বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার কারণে তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকার কারণেই এমনটি ঘটছে। আর তাতেই বাড়ছে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার হার। এ নিয়ে সরকারের পাশাপাশি উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘নির্বাচনের নামে এখন কী হচ্ছে তা সবাই দেখছেন। নির্বাচন কমিশন কতটা দায়িত্ব পালন করছে তাও আমরা দেখছি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়বদ্ধতা তাদের।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ দলের মনোনয়ন পেলেই জয়ী হওয়া যায়। এটা কোনো নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে না। এ বিষয়ে আর কী বলব।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিনাভোটে জয়ী হচ্ছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘যদি নির্বাচনে কোনো দল প্রার্থী না দেয়, সেক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলন কীভাবে হবে এই প্রশ্নটা থেকে যায়।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হবে অবাধ সুষ্ঠু ও সংবিধানের আলোকে। আর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এটা সবারই চাওয়া। সেজন্য প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। সব দলকে নির্বাচনমুখী করতে সরকার ও ইসির কিছু দায়-দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়-দায়িত্ব হয়েছে।’
গত সোমবার বাগেরহাটে ৬৬টি, খুলনায় ৩৪টি, সাতক্ষীরায় ২১টি, নোয়াখালীতে ১৩টি, চট্টগ্রামে ১২টি এবং কক্সবাজারে ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাট, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৪৩ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাগেরহাটে ৬৬ ইউপির মধ্যে ৩৮টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। বাকি ২৮ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
১৬০টি ইউপি নির্বাচনে ১৩১টিতে বিজয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী। বাকিগুলোতে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর ৯টি পৌর মেয়র পদে তিনটিতে আগেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। বাকি ছয়টির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগ এবং দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী পরিচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
এক সময়কার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইউপি নির্বাচনে এখন বিনাভোটে বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তারা মনে করেন, ইউপি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা দেখবে নির্বাচন কমিশন। তাই বিরোধী দলের কেউ নির্বাচন অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘একজন প্রার্থী যদি মনোনয়ন সাবমিট করে, তার বিপরীতে আর কেউ যদি না করে, সেক্ষেত্রে তো এই প্রার্থীর আর কিছু করার নেই। অন্য কোনো প্রার্থী না থাকলে যিনি থাকবেন তিনিই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। আইন ও সংবিধানের আলোকে তিনিই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হচ্ছেন।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘কাউকে নির্বাচন করানো বাধ্যতামূলক নয়। নির্বাচন কমিশন তো কাউকে নির্বাচন করতে মানা করেনি। কেউ নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ তো জোর করে কাউকে নির্বাচনে দাঁড় করাতে পারবে না। তাই প্রতিপক্ষ কেউ না দাঁড়ালে যিনি প্রার্থী রয়েছেন তিনি তো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই জয়ী হবেন।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা ছিল, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এতে সংঘাত ও প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হবে। এজন্য নির্বাচনে দলের কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে ভবিষ্যতে আর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে পারবেন না- দলের কেন্দ্র থেকে এমন কড়া বার্তা দেওয়া হয়। তারপরও বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন এবং শাস্তি হিসেবে বহিষ্কৃত হয়েছেন। কক্সবাজারে বিদ্রোহী হওয়ার কারণে এরই মধ্যে ১১ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। তবে বাগেরহাটের বেশির ভাগ ইউপিতে দলের কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সাহস পাননি। এ কারণে সেখানে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীর সংখ্যা বেশি বলে দলের নেতারা মনে করছেন।
এ বিষয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘যারা জয়ী হচ্ছে অবশ্যই তৃণমূলে তাদের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও তারা জনমত নিয়েই নির্বাচিত হচ্ছেন। কারণ তাদের জনপ্রিয়তা বেশি বিধায় তাদের বিপরীতে কোনো প্রতিপক্ষ দাঁড়াচ্ছে না।’
এ দিকে বিনাভোটে নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করছে না। অথবা নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা দৃশ্যমান নয়। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সরকারি দলের সঙ্গে অনেক সময় প্রশাসনের একটি অংশও জড়িয়ে পড়ছে। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। বিরোধী মতাদর্শের প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতেই পারছে না। মামলা-হামলা, ভয়ভীতি আর লোভ-লালসায় বিপর্যস্ত হচ্ছেন প্রার্থীরা।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার কথা নিয়ে নতুন করে কথা বলার মতো মানসিকতা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিনাভোট সব কিছুই তাদের দ্বারা সম্ভব। মাঠে কোনো প্রার্থী তারা রাখছে না। কৌশলে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র তুলে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার কোথায়ও টাকার খেলা চলছে। এ বিষয়ে দেশের মানুষও জানে। তাই মানুষ আর ভোট দিতে যায় না। যাওয়ার দরকারও পড়ে না।’
এদিকে ৪৩ জন প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার ঘটনা নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে এক লিখিত বক্তব্যে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটের টার্নআউট মোটামুটি ভালো ছিল, শতকরা ৬৯ দশমিক ৩৪ ভাগ। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ৪৩ জন প্রার্থী নির্বাচন না করেই চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হওয়া, নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে।