স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি সচেতনতা : সরকারিতে হয়রানি, বেসরকারিতে অধিক মূল্য
মিলান বার্তা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১৭:২০,অপরাহ্ন ২২ নভেম্বর ২০২১ | সংবাদটি ৩৯৩ বার পঠিতস্বাস্থ্যসেবায় দেশ অনেক এগিয়েছে বলা হলেও বাস্তবে তা কতটুকু সেই প্রশ্ন অনেকদিন থেকেই। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তা এখন বেশ মোটা দাগে স্পষ্ট হয়েছে। কাগজে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি মানসিক সচেতনতা। ফলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে না পড়লে লোকজন চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন না। যেসব অসুখের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি বা নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায় রোগের অবস্থা সে সব চিকিৎসায় মানুষের আগ্রহ অনেক কম। মূলত সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় হয়রানি আর বেসরকারিতে অনেক টাকা খরচের ব্যাপার থাকায় নিতান্ত বাধ্য না হয়ে মানুষ চিকিৎসার দ্বারপ্রান্তে যান না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা জরুরি। সচেতন না হলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রেখে লাভ হবে না। একইভাবে স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ততা না থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে না।
গবেষণায় উঠে এসেছে সংক্রামকের তুলনায় দেশে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হারও বেশি। তবে দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা নেয়ার মানসিকতা কমই রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত মানুষের ৬০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অনাগ্রহী। আর্থসামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুবিধা, স্বাস্থ্যতথ্য ঘাটতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কারণে সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত এসব মানুষ।
গবেষণার তথ্য বলছে, স্বল্পমেয়াদি বা মৌসুমি রোগ, দীর্ঘমেয়াদি রোগ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধার কারণে মানুষের চিকিৎসা সুবিধা নেয়ার জন্য মানসিকতার তারতম্য রয়েছে। যেসব রোগে মানুষ বছরের পর বছর আক্রান্ত থাকে ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সেসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার আগ্রহ দেখা যায়নি দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্যতা, ভৌগোলিক অবস্থান, মৌসুমি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মানসিকতা, চিকিৎসাসেবার ব্যয়ের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায় না। ২৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পায়, ১৩ শতাংশ মানুষ ফার্মেসি বা প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতাবিহীন চিকিৎসক ও ১ শতাংশ মানুষ অন্যান্য মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের আগ্রহ সবচেয়ে কম। ৬২ শতাংশ মানুষ এ তালিকায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষ সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা পায়। যার মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ রোগী ওষুধ এবং ১৪.৯ শতাংশ রোগী পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবাগ্রহণকারী অধিকাংশ রোগীকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ ক্রয় এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাব থেকে সেবাগ্রহণ করতে হয়। ফলে রোগীর ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছে ৬১ শতাংশ মানুষ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি। ৬৩ শতাংশ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য এ ব্যবস্থাপনার দ্বারস্থ হচ্ছে।
রোববার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ উপস্থাপিত এই গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয় বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাক্রিডিটেশন পদ্ধতি না থাকা এবং সেবা মান ও মূল্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় সেবাগ্রহণকারী জনগণ প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেবা বিষয়ে রোগীদের অসন্তুষ্টি ও কখনও কখনও আস্থার ঘাটতি তাদের দেশের পরিবর্তে বিদেশ থেকে সেবাগ্রহণে উৎসাহিত করে। এভাবে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেক মানুষ ভিটে-জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
তবে জরুরি ওষুধের তালিকা সংশোধন ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপত্রে প্রটোকল অনুসরণ করে কোম্পানির ওষুধের ‘ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের পরিবর্তে’ জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে এ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, শ্বাসকষ্ট, থ্যালাসেমিয়া, বিষন্নতা, মানসিক সমস্যা, নার্ভ সমস্যা, অটিজম, জেনেটিক রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, হরমোন সমস্যা, স্ট্রোক, ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাকসহ নানা রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি রোগের জন্য চিকিৎসাসেবা নেয়ার আগ্রহ না থাকার কারণ হিসেবে তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, তথ্য সুবিধা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা কম থাকার কথা বলছে। তাদের মতে, চিকিৎসা শুধু ওষুধ গ্রহণ করা নয়। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসকের পরামর্শ এবং সার্জারি সেবা গ্রহণ পর্যন্ত যাবতীয় সেবা অন্তর্ভুক্ত। দেশে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও সেবা গ্রহণের মানসিকতা তৈরির জন্য সচেতনতা তৈরি করা যায়নি। অন্যদিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হয়রানি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহণে মূল্য বেশি হওয়ায় মানুষ খুব বাধ্য না হলে চিকিৎসা নিতে যায় না।
চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০-এর তথ্যমতে, দেশে ১৫টি কারণে স্থূল মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে অসংক্রামক রোগের সংখ্যাই বেশি। গত বছর প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে রোগে স্থূল মৃত্যু হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। আর শহরে হাজারে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ স্থূল মৃত্যুহার থাকলেও গ্রামাঞ্চলে তা ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
চিকিৎসাসেবার অপর্যাপ্ততার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসাসেবা নিতে অনাগ্রহী বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ। তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। এক্ষেত্রে জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। আবার যারা চিকিৎসা নেন, তাদের প্রায় অর্ধেক নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করে না। অনেকে প্রথমবার চিকিৎসা নিয়ে পরে আর চিকিৎসকের কাছে যায় না। চিকিৎসকের কাউন্সেলিং, রোগ নিরীক্ষণ, ওষুধ গ্রহণ করা ও সার্জারি সবকিছুই চিকিৎসাসেবার অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়টিকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপদান করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসা নিতে মানুষ তখনই আগ্রহী হবে, যখন কম মূল্যে পর্যাপ্ত সুবিধা ও হয়রানি থাকবে না।
চিকিৎসা নেয়ার মানসিকতা না থাকার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার অপর্যাপ্ততার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, নানা বিড়ম্বনায় মাঝপথে চিকিৎসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অনেকেই। গ্রাম ও শহরে পারিবারিক চিকিৎসক বা কমিউনিটি চিকিৎসক থাকলে মানুষ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পেত। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হয়ে যেত। ফ্যামিলি চিকিৎসক বা কমিউনিটি চিকিৎসক রোগ নিরীক্ষণ করতে না পারলে হাসপাতালে পাঠাতেন। পর্যায়ক্রমিক এসব ধাপ অনুসরণ না করে মানুষ নিজেরাই বিভিন্ন হাসপাতালে যায়। কোথায় গেলে সঠিক চিকিৎসা হবে তা জানা নেই। এতে হয়রানির শিকার হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ভুক্তভোগীরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রামক, মৌসুমি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে রোগীদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখা গেছে। মৌসুমি ও সংক্রামক রোগ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি দেখা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে আগ্রহ কম হওয়ার অন্যতম কারণ, সেবা প্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। এতে শিক্ষা ও সচেতনতার প্রভাবও রয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগ নির্ণয় ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলছে সংস্থাটি।
রোগের চিকিৎসা নেয়ার আগে প্রতিরোধী ব্যবস্থার জন্য মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপে ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, মানুষের সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা জরুরি। সচেতন না হলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রেখে লাভ হবে না। একইভাবে স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ততা না থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে না। প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়ার পর তাতে উন্নতি না হলে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধী ব্যবস্থায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাহলে রোগের ক্ষেত্রেও চিকিৎসা নিতে মানুষ অনাগ্রহ দেখাবে না।